1. [email protected] : Admin : sk Sirajul Islam siraj siraj
  2. [email protected] : admi2017 :
  3. [email protected] : Sk Sirajul Islam Siraj : Sk Sirajul Islam Siraj
ব্রেকিং নিউজ :
বিনোদন :: গান গাইতে গাইতে মঞ্চেই গায়কের মর্মান্তিক মৃত্যু!,  খেলার খবর : অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ, বিমানবন্দরে যুবাদের জানানো হবে উষ্ণ অভ্যর্থনা,

শাহনামা কাব্যের রচয়িতা কবি ফেরদৌসি

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২২
  • ৭৪৩ বার পঠিত

আফতাব চৌধুরী:
তখনকার যুগে পৃথিবীর মহাকাব্য সমূহের মধ্যে অন্যতম হল ‘শাহনামা’ কাব্য। ‘শাহনামা’ কাব্যের রচয়িতা হলেন খ্রিস্টিয় নবম শতাব্দীর কবি ফেরদৌসি। সে যুগে কবি সাহিত্যিকের অভাব ছিল বটে, কিন্তু তাদের সমাদর কম ছিল না। মর্যাদা ছিল অনেক উচ্চে। চন্দ্রবংশীয় যুগ থেকে মোগল যুগে কবি, সাহিত্যিকের স্থান যে কত উচ্চে ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সমস্ত ‘জাত’ কবিদের রচনাশৈলীতে রয়েছে মানব জীবনদর্শন ও চলার পথ।
হ্যাঁ, অন্যান্য ‘জাত’ কবিদের মধ্যে ‘শাহনামা’ কাব্যের রচয়িতা কবি ফেরদৌসি সারা জীবন মানব কল্যণে নিয়োজিত ছিলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত বিদায়ের ডাক না আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত মানবকল্যাণে নিয়োজিত ছিলেন।
বর্তমানে অধিকাংশ কবিদের লেখা কবিতা একবার পড়লে আরেকবার পড়তে ইচ্ছে হয় না। তখনকার কবিতা বা পাঠক এমন ছিল না। পাঠক যখন কবিতাগুলো পড়েন তখন মনে করেন নতুন। প্রায় হাজার বছর অতিবাহিত হলেও আজও অনেকের কন্ঠে উচ্চারিত হয় তাঁর কবিতা শ্লোক। কী যেন আকর্ষণ, সত্য লুকিয়ে রয়েছে। নেই কোনো বিরক্তি, অতৃপ্তি বা তিক্ততা।
লোকমুখে কবি ফেরদৌসির সুখ্যাতি শুনে গজনির সুলতান মাহমুদ তাঁকে রাজদরবারে নিয়ে আসার আকাক্সক্ষা পোষণ করলেন। রাজদরবারে আসার পর এ বলে সুলতান মাহমুদ তাকে আলিঙ্গন করে বললেন-
‘আয় ফেরদৌসি
তু দরবার মে-ফেরদৌসি করদি’
অর্থাৎ- ‘হে ফেরদৌসি, তুমি সত্যি আমার দরবারকে স্বর্গ বানিয়েছ। ’
ইরানের বিখ্যাত কবি নিজামি আরযি তার ‘দিবাচার’ গ্রন্থে ফেরদৌসি সম্বন্ধে যা লিপিবদ্ধ করেছেন তা থেকে জানা যায়- ‘শাহনামা’ কাব্যের রচয়িতা ফেরদৌসি ৯৪১ খ্রিস্টাব্দ ইরানের সমরখন্দের অন্তর্গত ‘তুস’ নগরের ‘ঝাঝ’ নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম-মোহাম্মদ আবুল কাশেম। তাঁর প্রতিভা ও সুখ্যাতির জন্য গজনির সুলতান তাঁকে ফেরদৌসি উপাধি প্রদান করেন। তখন থেকেই মহাকবি ফেরদৌসি নামে পরিচিত।
তিনি উর্দু, ফার্সি কবিতা লিখতেন, অতি অল্প বয়স থেকে কবিতা লিখতেন। একাকী নদীর তীরে বসে বা নির্জন স্থানে বসে লিখতেন। সুখ, শান্তিময় পরিবার ছিল। অল্প বয়সে বিবাহ করেন। অল্প দিনের একটি কন্যা সন্তান রেখে স্ত্রী চিরবিদায় নিলেন। কবির আরেক অধ্যায় বিষাদগ্রস্থ জীবন শুরু হল। অপরদিকে ‘তুসের’ শাসনকর্তার রাজনৈতিক কারণে তাঁর উপর কুদৃষ্টি পড়ল। অবশেষে পিতৃ গৃহ ত্যাগ করলেন একমাত্র কন্যাকে নিয়ে।
৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ গজনির শাসক ছিলেন সুলতান মাহমুদ। সুলতান দেশী-বিদেশী কবি, সাহিত্যিক, জ্ঞানী ব্যক্তিদের সমাদর করতেন। মোহাম্মদ আবুল কাশিম ফেরদৌসী যথাযথ মর্যাদা পাবেন বলে সুলতান মাহমুদের রাজদরবারে যাবার ইচ্ছা পোষণ করলেন। অবশেষে সুলতানের উজির মোহেক বাহাদুরের সহযোগিতায় রাজদরবারে স্থান পান তিনি। শাহি দরবারে কবিদের কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে কবিদের মর্যাদার স্থান নির্ধারণ হত।
অচিরেই আবুল কাশিম ফেরদৌসি মর্যাদার সর্বোচ্চ স্থান দখল করেন। অর্থাৎ সুলতান মাহমুদ তাঁকে শাহি দরবারে ‘রাজকবি’ হিসাবে মনোনীত করেন। কবি ফেরদৌসির সাথে সুলতানের গভীর সম্পর্ক ও রাজদরবারে কবিতার সম্মান, মর্যাদা দেখে রাজসভার অন্যান্য কবিরা ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠলেন। এমনকি সুলতানের প্রধানমন্ত্রী খাজা ময়সন্দি ফেরদৌসির বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র শুরু করতে লাগলেন। ওদিকে সুলতান মাহমুদ ‘শাহনামা’ কাব্য রচনা করতে ফেরদৌসিকে অনুরোধ করেন। ঘোষণা করলেন উক্ত কাব্য রচনায় প্রতিটি শ্লোকের জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করা হবে। ফেরদৌসি একটু চিন্তা করে এ গুরুদায়িত্ব হাতে নিলেন। এ পারিশ্রমিক দিয়ে নিজ দেশের অসহায়, নির্যাতিত, গরিব, দুস্থ লোকের এবং স্বীয় কন্যাসন্তানের কিছু উপকার করবেন বলে ধরে নিলেন।
যতদূর জানা যায়, ফেরদৌসি সূদীর্ঘ ৩০ (ত্রিশ) বছর পরিশ্রম করে ‘শাহনামা’ কাব্য রচনা করেন। শেষের ২০ (বিশ) বছর তিনি এ রাজসভায় কাটান। ‘শাহনামা’ পৃথিবীর মহাকাব্য সমূহের মধ্যে অন্যতম। ৭টি বৃহৎ খণ্ডে বিভক্ত ও ৬০ (ষাট) হাজার শ্লোক রয়েছে এতে।
এদিকে, ‘শাহনামা’ কাব্য সম্পূর্ণ হবার পর রাজ দরবারের কতিপয় ঈর্ষাপরায়ণ কবি ও আমলাদের কু-মন্ত্রনার সুলতান মাহমুদ তাঁর পূর্বের দেয়া প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করেন। ৬০ (ষাট) হাজার স্বর্ণমুদ্রার স্থলে ৬০ (ষাট) হাজার রৌপ্যমুদ্রা প্রদান করেন। সুলতানের এ হীন কার্যের জন্য ফেরদৌসি ক্রোধে, দুঃখে, অস্থির হয়ে উঠলেন। অসহায় বোধ করলেন। সুদীর্ঘ ৩০ (ত্রিশ) বছর পরিশ্রমের মূল্য কি এই? সুলতান হয়ে কিভাবে প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করলেন? তিনি কি না নিজ দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য এত পরিশ্রম করেছিলেন। তাই সুলতানের দেয়া সমুদয় অর্থ ভৃত্য, কৃষক ও নিকটস্থ গরিব লোকদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন।
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে কবি সাহিত্যিকের শুক্র হয় সাধারণ কিছু মেকি কবি সাহিত্যিক। আবুল কাশিম ফেরদৌসির জীবন বিষিয়ে দিয়েছিলেন রাজদরবারের কবি, আমলারা। রাজসভার অন্যান্য কবি আমলারা তাঁর প্রকৃত মূল্য সুলতানের কাছে তুলে ধরেনি বরং সুলতানের দেয়া অর্থ না নিয়ে বিলিয়ে দেবার ব্যাপারে সুলতানের অবমাননার কথা প্রচার করলেন। তারা মিথ্যা ও বানানো কর্থাবার্তা বলে কবির বিরুদ্ধে গজনির সুলতানকে ক্ষেপিয়ে তুলতে তৎপর হন। সুলতান ক্ষেপে কবি ফেরদৌসিকে হাতির পদতলে পিষ্ট করে হত্যার হুকুম দেন। পরক্ষণে তা রোধ করে গজনি ত্যাগের আদেশ দেন। ফেরদৌসি অবশ্য সুলতানের হীন আচরণের জবাবে গজনি ত্যাগের পূর্বের রাত্রের অন্ধকারে মসজিদের ও রাজদরবারের বিশেষ কিছু স্থানে একটি ব্যঙ্গ রসাত্মক কবিতা লিখে গজনি ত্যাগ করেন। মূল কবিতাটি ফার্সি। অর্থ হল-
‘রাজবংশে হত যদি জন্ম তোমার, বখশিতে স্বর্ণমুদ্রা মুকুট সোনার। উচ্চ মান নাহি যার বংশের ভিতর, কেমনে সহিবে সে মানীর আদর।  তিক্তবীজ হতে যে তরুর জন্ম, নন্দন কাননে তারে কর রোপণ। সিঞ্চন কর মূলে মন্দাকিনী ধারা, মধু আর দুগ্ধে ভরা খাদ্যের পশরা।
তথাপি ফলিবে তার আপন স্বভাব, সতত সে তিক্ত ফল করিবে প্রসব। এ বিরক্তিকর ব্যঙ্গ কবিতাটি দেখে সুলতান মাহমুদের রাগ ক্ষোভ কবির প্রতি আরো তীব্র হল। কিন্তু সুলতান যখন একা বসে থাকেন, বিবিধ চিন্তা মাথায় এসে যায়। তিনি ভাবেন কেন ফেরদৌসির এত ক্ষোভ? কেন ফেরদৌসি এসব লিখল? কি তার উদ্দেশ্য? একটিবার কি ভয় করল না? যে সদ্য মৃত্যুদন্ড থেকে মুক্তি পেয়ে বেঁচে গেল, তাঁর এত সাহস? এত সব পক্ষে বিপক্ষে চিন্তা করতে থাকেন সুলতান মাহমুদ।
ইতিপূর্বে কবি ফেরদৌসির সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। তৎসত্তে¡ও কবির ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা বহু দূর ছড়িয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে গজনি ত্যাগ করে ফেরদৌসি কুহেস্তান রাজ্যের রাজা নাসির উদ্দিন মুহতাসেখের নিকট রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাজা নাসির উদ্দিন মুহতাসেখ ওদিকে আবার সুলতান মাহমুদের প্রিয় বন্ধু। ফেরদৌসির সকল সুখ দুঃখের আদ্যোপান্ত শুনলেন কিন্তু রাজা নাসির উদ্দিন অত্যন্ত দুঃখ পেলেন তাঁর পরমবন্ধুর প্রতি এ ব্যঙ্গ রসাত্মক কবিতা পড়ে। তিনি চাইলেন না তাঁর প্রিয় বন্ধুর প্রতি কটাক্ষপূর্ণ বিষয় আরো ছড়িয়ে পড়–ক। তাই তিনি কিছু অর্থের বিনিময়ে মূল লিপিটি নিয়ে তা জ্বালিয়ে দিলেন। রাজনৈতিক আশ্রিত কবির দিনগুলো খুব সম্মানজনক আনন্দের সাথে কাটছিল।
এদিকে কবি ফেরদৌসির পান্ডিত্যের খ্যাতি দিন দিন বাড়ছিল। কবিকে গ্রহণ করার জন্য দেশ বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ আসতে থাকে। কবি কোনো আমন্ত্রণ গ্রহণ না করে সেখান থেকে স্বীয় কন্যাকে নিয়ে বাগদাদে চলে যান। তৎকালীন বাগদাদের শাসক কবিকে পেয়ে খুব আনন্দিত হন। সেখানে অবস্থানকালে ইউসুফ জুলেখার কাহিনী অবলম্বনে ১৮, ০০০ শ্লোকের প্রেমের কাব্য রচনা করেন কিন্তু কালের গতি প্রবাহে অতীতের গর্ভে তা বিলীন হয়ে যায়। কবির মন স্থির নয়। সেখান থেকে থেকে চলে যান নিজ মাতৃভূমি ইরানের ‘তুস’ নগরীতে।
সুলতান মাহমুদ নিজের ভুল বুঝতে পারলেন অবশেষে। রাজদরবারের অন্যান্য কবি, আমলাদের কু-মন্ত্রণার কথা বুঝতে পারলেন। ঈর্ষাপরায়ণ কবিদের বিতাড়িত করেন। ষড়যন্ত্রকারী প্রধানমন্ত্রীকে বহিষ্কার করেন এবং কবি ফেরদৌসিকে যে কোনো উপায়ে ফিরিয়ে আনতে চাইলেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিলেন যাতে কবিকে যেন দেয়া হয়। সুলতান মাহমুদ বাগদাদের শাসনকর্তার নিকট পত্রের মাধ্যমে কবিকে ফিরিয়ে দেয়ার আহŸান জানান। কিন্তু বাগদাদের শাসনকর্তা তা মেনে নিলেন না বরং পত্রের কোণায় অলিফ লাম-মিম লিখে ফেরত দিলেন। সুলতান মাহমুদ ও রাজদরবারের কেউ এ বাক্যটির অর্থ উদঘাটন করতে পারলেন না। তখন কবি ফেরদৌসির উপস্থিতির কথা মনে করলেন। ফেরদৌসি নিশ্চয় এর অর্থ উৎঘাটন করতে পারতেন।
সুলতানের ঘনিষ্ট বন্ধু কুহেস্তানের রাজা নাসির উদ্দিন পত্রযোগে কবি ফেরদৌসির প্রশংসা করেন। তাতে উল্লেখ করলেন সুলতান কবির প্রতি ন্যায় আচরণ করেননি। ষড়যন্ত্রকারীর কুপরামর্শে। তাই সুলতান মাহমুদ নিজেকে অপরাধী মনে করে কবি ফেরদৌসিকে ক্ষমা করে দেন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী ৬০(ষাট) হাজার স্বর্ণমুদ্রাসহ কবির জন্মভূমি ইরানের ‘তুস’ নগরীতে কবির বাড়ি পৌঁছলেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছে জানতে পারলেন কবি ফেরদৌসি পৃথিবীতে আর বেঁচে নেই। ১০২০ খ্রিস্টাব্দে কবি এ অশান্তময় পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। কবির মৃত্যুর হাজার বছর অতিবাহিত হলেও কবি যে কাব্য, সাহিত্য রেখে গেছেন তা কখনো ভোলার নয় আজও সমাদৃত।কবিকে তিনি যথাযোগ্য মর্যাদা দান করেননি।

সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

প্লিজ আপনি ও অপরকে নিউজটি শেয়ার করার জন্য অনুরোধ করছি

এ জাতীয় আরো খবর..